মিলন (অনুগল্প)

সে আমার সামনে বসে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। পুরো বধূ সেজে বসে আছে। মাথার ঘোমটা একেবারে বুক অবধি নুয়ে আছে। তারপরও মুখের কিছু অংশ দেখা যেত। কিন্তু সে মুখটা একেবারে নি¤œগামী করে রেখেছে।
তার সাথে আমার এক বছরের প্রেম ছিল। পরে ব্রেকআপ হয়ে যায়। বয়সের দোষে ব্রেকআপ হয়। ঠুনকো অজহাত। এরকম ঠুনকো অজুহাতে এক বছরের ভেতরে আমাদের চার-পাঁচবার ব্রেকআপ  হয়েছে। কেউ কাউকে ছাড়তে পারি না বিধায় আবারও জোড়া লাগে আমাদের। কিন্তু শেষবার আর পারা গেল না।
কি করে যেন তার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল। বলা যায় একেবারে কাকতালীয়ভাবে। কয়েক জায়গায় আমার মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। সবই আম্মার পছন্দ-অপছন্দ। আমার ভেতর কেন যেন একটা উদাস ভাব চলে আসে। মেয়েদের দিকে তাকাতে খুব একটা ভাল লাগে না। আমি আম্মাকে ডাইরেক্ট বলে দিয়েছি, তোমার যাকে ভালো লাগে পুত্রবধূ করে নিয়ে আসতে পারো। দেখতে পেতœী টাইপের হলেও চলবে।
আমি তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। মিনিমাম আধঘন্টা তো হবেই। এরকম সময় এবং এরকম পরিবেশে আধঘন্টা অনেক সময়। তার যে এত ধৈর্য আছে সেটা তো জানতাম না। খুব উচ্ছল টাইপের ছিল। উচ্ছলা হরিণী। আসলেই সে হরিণী।
প্রেমিকাকে সবাই খুব সুন্দরী বলে। আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। তবে এটুকু বলি, তার দুরন্তপনা দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। এখনো মনে আছে ছাদে যখন তার সাথে দেখা করতাম, একবার আমার কাছে আসত আবার দূরে সরে যেত। একদিন বলল, এরকম অবস্থায় কেউ দেখলে আমাকে কি কেউ ভালো মেয়ে বলবে?
তাদের বাসায় আমরা দুবছর ভাড়া ছিলাম। আমরা দুতলায় থাকতাম তারা নিচতলায়। পরে আমরা বাসা কিনে চলে আসি। চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়ে যায়। এইজন্য হয়তো আমাদের আর জোড়া লাগেনি।
মেয়ে দেখতে দেখতে আম্মা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কাউকে তার পছন্দ হয় না। আবার যাকে মনে ধরে সে মেয়ের পরিবার তার ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবে না। অবশেষে আম্মার মনে পড়ল, এরকম মনে ধরার মতো এবং হয়তো তার ছেলেকে অপছন্দ করবে না এরকম একটি মেয়ে আছে।
যথারীতি কথাবার্তা শুরু হলো এবং একদিন শেষও হলো। বাংলাদেশে এখনো মনে হয় বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েকে খুব একটা পাত্তা দেয়া হয় না। অনেকে হয়তো জানেই না তার বিয়ে কবে। আমার সন্দেহ হয়, তাসনিয়াকে বিয়ের কথা জানানো হয় নি। বিশেষ করে পাত্র সমন্ধে। মেয়েদের সমন্ধে আমার কিছু অভিজ্ঞতা এবং মানুষের কথায় বুঝতে পারি, মেয়েরা খুব সফট থাকে কিন্তু কখনো হার্ড হয়ে গেলে খবর আছে।
তাসনিয়া আমার সাথে বিয়েতে রাজি হবে। এটা বিয়ের মাইক্রো সেকেন্ড আগ পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হয়নি। আমার প্রায় দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই শুনব তাসনিয়া বিয়েতে অমত প্রকাশ করেছে। আমি সেই ধাক্কা সামলে নিতে পুরো প্রস্তুত থাকি। চিন্তার বিষয়, শুধু আম্মাকে নিয়ে। মেয়ে মানুষ তো। বয়সও হয়েছে। এই জন্য বাড়তি কিছু অ্যাক্টিং করতে থাকি।
কি হলো, এমন ত্যাবদা মেরে বসে আছ কেন? বাসর রাতে কি কেউ এরকম সুন্দরী বউকে পাশে রেখে উদাস হয়? আগে আমাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরার মতলব থাকত। এখন কি নেই?’ তাসনিয়া পটপট করে কথাগুলো বলে গেল। তার মুখে কখনো জড়তা কাজ করে না। এটা আমি জানি।
= ‘গভীর চিন্তা করছি।
=  ‘কি এমন গভীর চিন্তা। জানতে পারি?’
= ‘না জানলেও সমস্যা না। চিন্তা করছি, তোমাকে ছেড়ে আমি এই তিনটে বছর কীভাবে কাটালাম? তোমাকে ছাড়া তো আমি একমূহুর্ত থাকতে পারব বলে বুঝতে পারছি না।
সে মুখ বাঁকা করে বলল, ‘তুমি কি আজকাল মিথ্যা কথা বলা শুরু করলে?’
= ‘আসলে কথাটা মিথ্যার মতো শুনাচ্ছে। এই কথাটা তুমি বললেও আমি এরকম ধরে নেব।
= ‘তুমি পুরোনো খাসলত পরিবর্তন করতে পারলে না। খালি রাগ দেখানো। আর সব রাগ আমার সাথে। আমি এমনি বললাম। তুমি আমাকে ভুলে যাবে এটা আমি কখনো মেনে নিতে পারি না।
= ‘আর তুমি আমাকে ভুলে থাকতে পার। তাই না?’
= ‘হ্যা, অবশ্যই আমি তোমাকে ভুলে থাকতে পারি। প্রুফ তো দেখিয়েছি।
= ‘তা অবশ্যই ঠিক। আমি কেন যে হরিণীর প্রেমে পড়েছিলাম।
সে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি ভয় পেয়ে যাই, কি হলো। আমি তার কাছে যাই। শরীরে হাত দিতে যাব, কারেন্ট শক খাই। আমার শরীরে হাত দিও না।সে বলল।

কথাটা অনেকদিন পর শুনা গেলেও এরকম কথা অনেক শুনেছি। মাঝখানে তিন তিনটে বছরের চলে যাওয়া। আমার দেখি অটোমেটিক কান্না চলে আসে। গলার তলায় কফের মতো কি যেন বাঁধতে শুরু করে। আজও আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছে।

Comments

  1. এমনি মধুর সন্ধিক্ষণে
    হরিণীর জ্বালাময়ী বাণী কি মিলনের স্বাদ আরো দ্বিগুণ করে দিয়েছিল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে কি আর বলতে? হরিণীর ছটফটানির জ্বালায় তিনি অস্থির থাকেন সারাক্ষণ।

      Delete

Post a Comment