দুঃখের গান

গলির মোড়ের রজবের চায়ের দোকানে প্রায় ধপাস করে বসি। প্রতিদিন এই সময় মানে সাজের বেলা তার দোকানে বসে পায়ের ওপর পা তুলে এক কাপ চা না খেলে রাতের পড়া হজম হয় না।

আজ চা খাওয়া হবে ঠিক তবে পায়ের ওপর পা তুলা হবে না। কারণ রজবের টি-স্টলের প্রায় সিংহভাগ দখল করে বসে আছেন পাড়ার দুই বড় ভাই, পটল ভাই আর মোহন দা।

আমার মনটা পুরাই খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহর দুনিয়ায় বহু আকামের বাদশা দেখেছি, কিন্তু এরা তাদের থেকেও দু’চামুচ অ্যাডভান্স। কোনো কাজ কাম নাই, ফাউল বিষয়াদি নিয়ে সারাদিন ঝগড়া করে। কোনো বিষয়ে তারা এক হতে পারে না। একজন হ্যা বললে অন্যজন মুখের ওপর না করে বসে।

আমি চিপার দিকে একটা চেয়ারে বসি। বসতেই ঠের পাই চেয়ার বাবাজির শরির-সাস্থ ভালো না। যে কোনো সময় ইন্তেকাল ফরমাইতে পারেন।

পঠল ভাই বিশেষজ্ঞের মতো কয়েকবার মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, তোর কী মনে হয়, ওই যারা গান গায়, কি যেন বলে সিঙ্গার। তারা কি জন্যে এত দুঃখ কষ্টের গান গায়? তারা কি সত্যিই এতটা দুঃখি?

মোহন দা ঠোঁট দুটো দুদিকে মেলে ধরে বলল, তুই এইটা কি বললি? বাংলাদেশের দুই শ্রেণির লোক সোনার চামুচ মুখে ‍দিয়ে জন্মায় এর মধ্যে এক শ্রেণি হল, রাজনীতিবীদের পুলা-মাইয়া, আর আরেক শ্রেণি হল, শিল্পী মানে গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী।
=তাহলে এরা এই গানগুলো গায় কি জন্যে?

=তোর কি ধারণা, এরা নিজেদের প্রেম-ভালবাসায় ছ্যাকা খেয়ে তারপর দুঃখ-কষ্টের গান গায়?

=হ্যা, আমার তো সেইটাই মনে হয়।

=তাহলে তুমি বোকার স্বর্গে আছ। শুধু আছ না, একেবারে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছ। স্বর্গে তো আবার ভুখ বলে কিছু নাই!

পঠল ভাই মুখ কটমট করে বললেন, তুই দেখি একেবারে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে গেছিস! ইহকাল পরকাল সব খবরা খবর রাখস।

=আরে শুন, আজ কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছি, কোনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করব না। সো, কোনো বাড়াবাড়ি না।

=তাহলে সহজে ব্যাপারটা বলছিস না কেন? জল ঘোলা করছিস কেন?

=শোন, আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করে এবং যারা গান গায়, তারা কিন্তু জনদরদি। রাজনীতিবীদরা স্কুল বানায়, কলেজ বানায়, ভার্সিটি বানায় অথচ তাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হবার জন্যে বিদেশ যায়। এখন তুই বলতে পারিস, তাহলে এগুলো কেন? এইটার সহজ-সরল আনসার, তারা নিজেদের জন্যে কিছু করে না। জনগনের কথা মাথায় রেখে এগুলো করে।
তেমনি তুই দেখিস, শিল্পীরা পাঁচ-দশটা মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কয়েকদিন পর পর প্রেমিকা পাল্টায়, বিয়ে করে, কিছুদিন সংসার করে, এইটাকে ত্যাগ করে আরেকটার পিছু নেয়। কতকিছু করে। বলতে পারিস, তার অল টাইম সুখের বেলায় ভাসতে থাকে। এখন প্রশ্ন করবে, এত দুঃখের গান কেন গায়? এইটার উত্তর প্রথমটার মতোই। জনগন মানে তোর আমার মতো যারা বেকার কিন্তু প্রেম করে, প্রেমিকার সাথে লদকালদকি হতে যাবে এমন সময় শুনা গেল প্রেমিকার বিয়ে হতে যাচ্ছে। মেয়েটা সেই বরকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখছে। একদিন দেখলে সেই মেয়েটা একটা রাশভারি টাইপের ছেলের সাথে হেসেখেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার সাথে চোখাচুখি হলে, এমন ভাব ধরে যে তুমি কে সে চিনে না। তোমার সাথে তার কোনোদিন কোনো কথাটথা হয়নি। এই জনমে তো নয়ই আগের জনমেও না।

পঠল ভাই টেবিলে হালকা করে দুই তিনটা চাপড় মেরে বললেন, জীবনে কোনোদিন তোর সাথে একমত হইনি আজ কিন্তু হলাম। একেবারে খাটি কথা কইছিস।

আমি আর বসলাম না। এই বিশারদদের কাছে আর বসা যাবে না। এমনিতেই ক’টা দিন খারাপ যাচ্ছে। প্রেমিকার বিয়ে যাচ্ছে, এটা জানার পর কি আর সুস্থ হালে থাকে যায়?

Comments