শাওন, একটা কাজ কর। পারবি?
হঠাৎ কথাটা শুনি। ডান পাশ থেকে এসেছে। দাদা ভাই-ই
বলেছেন। প্রতিদিন আমার ডান পাশে বসে জাবের। সেকেন্ড বয়। আজ তাকে প্রায় জোর করে
তাড়িয়ে বসেছেন দাদা ভাই। তাকে দাদা বললেই হয়ে যেত। লম্বা করে দাদা ভাই বলা লাগত
না। কিন্তু শ্রুতিমাধুর্যের একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। তাই না! দাদা ভাই নামের
একটা সার্থকতা আছে। তিনি আমাদের অনেক বড়। আমরা দুতিনটার বয়স একত্রে তার বয়স হবে।
একটি ক্লাসে তিন-চার বছর কাটালে যা হয়।
কী বল না? কাজ না বলেই পারবি কী
নাতে চলে গেলে। আমি হালকা বিরক্তির
সাথে বললাম।
স্যারকে কিছু নাস্তা করা।
কেন? ব্যাটা আজ আমাদের পিটিয়ে হাড় গুড়ো করবে। তাকে আবার
নাস্তা করাবে?
দাদা ভাই হাসি হাসি মুখে বললেন, তুই শুধু একটা বোকা না,
মহাবোকা। আরে ঘুষ, বুঝলি না! ঘুষ।
ভালোমতেই বুঝেছি। তবে কাজটা আমি করতে পারবনা। শিমুলকে
বল।
তা হলে তুই ওকে বল।
সে তোমার সোজা পেছনে আছে, তুমিই বলে ফেল।
দাদা ভাই বাঁকা চোখে আমাকে দেখেন। পরে মাথা নিচু করে
শিমুলকে ধাক্কা দিয়ে কথাটা বললেন। সে লাফ মেরে ওঠে। পাগলের মতো করে বলে দাও টাকা
দাও। আমি এখনই যাচ্ছি।
তার আচানক এই অবস্থা দেখে আমরা ঘাবড়ে যাই। পাছে আবার
স্যার দেখে ফেলেন কিনা। তিনি ক্লাসময় চক্কর দিচ্ছেন।
যা ভেবেছি তাই হলো। স্যার পেছন থেকে হুংকার দিলেন। কী ?
লাফালাফি করছিস কেন? সারাদিন বাঁদরামি করে শেষ হয়না? বস, ঝটপট অংকগুলো করে খাতা
জমা দাও।
শিমুল অতি বিনীতভাবে বলল, স্যার আমার কলমের কালি শেষ হয়ে
গেছে। নাইন থেকে একটা নিয়ে আসি!
এই কথা উঁচু কন্ঠে বললেও নিচু গলায় আরেকটি কথা বলল, টাকা
দিচ্ছ না কেন?
দাদা ভাই কাঁপা
কাঁপা হাতে শিমুলের প্যান্টের পকেটে বিশ টাকা গুজে দিলেন।
স্যার মুখ ভয়ংকর করে বললেন, আজ তোমাদের অংকের এক্সাম।
তুমি জান না?
জানি স্যার।
তাহলে ভালো দেখে কলম আনলে না?
ভালো দেখেই তো কলমটা আনলাম। কিন্তু হঠাৎ যে কালি দেয়া
বন্ধ করে দেবে, সেটা কে জানত? এটা কি আমার দোষ?
স্যার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, না এটা আমার দোষ! শুধু
মুখে মুখে কথা। তোদের মতো গর্দভদের যে কী করি! যা তাড়াতাড়ি কলম নিয়ে আয়।
আজ আমাদের অংকের পরীক্ষা। সিস্টেমটা এই প্রথম। আগে কখনও
এরকম হয়নি। স্যারের মাথায় মনে হয় হালকা ছিট টিট আছে। কিছুদিন পরপর নতুন নতুন
পদ্ধতি আবিস্কার করেন। একদিন ক্লাসে ঘোষণা করলেন, দশদিন তোদের অংকের ক্লাস বন্ধ।
কথাটা শুনে আমরা তো হইচই শুরু করি। যা বাবা দশটা দিন প্লাস-মাইনাস, হাবিজিবি মাথায়
ভর ভর করলনা। পরক্ষনেই তিনি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, তোরা এই দশদিন পাঁচ, ছয়,
সাত ও আট অনুশীলনী সম্পন্ন করে ফেলবে। আমি হেঁটে হেঁটে সবার খাতা দেখব। আমাদের তো
ক্যারেমেরে অবস্থা।
আরেকদিন এসে বললেন, এখন সেমিস্টার পদ্ধতিতে তোদের ক্লাস
হবে।
আমরা অবাক হয়ে বললাম, সেমিস্টার কী স্যার?
প্রতি মাসে মাসে পরীক্ষা হবে।
আমাদের তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। এ কী, বছরে
তিনটা পরীক্ষা দিয়েই আমাদের ছেড়েবেড়ে অবস্থা। পরীক্ষার জন্যে নাওয়া, খাওয়া সব
বিসর্জন দিতে হয়। এমনকি পরীক্ষার চিন্তায় পড়তেও পারিনা। মাসে মাসে পরীক্ষা হলে
আমাদের যে কী হবে....... উফ চিন্তাই করতে পারছিনা।
ফার্স্টবয় খুশি খুশি মুখে বলল, সকল বিষয়ে মাসে মাসে
পরীক্ষা হবে স্যার?
না শুধু গনিত।
ফার্স্টবয় কিছুটা হতাশ হয়েছে। আল্লাহ পাকের দুনিয়ায়
ফার্স্টবয়রা মনে হয় আলাদা একজাতি। যত কঠিন কঠিন ব্যাপারে তারা আনন্দ পায়।
আমরা কিছুটা হাফ ছাড়ি। ভালমতন হাফ ছাড়তে পারিনি। কী করে
পারব? মাথা মগজ সব তো উল্টা পাল্টা করে দেয় এই ব্যাটা অংকই।
দাদাভাই আমাকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বললেন, কী রে ও এত
দেরী করছে কেন? দুতিনটা সিংগাড়া আনতে এত সময় লাগে?
আমি মনে মনে বললাম, সেইটার তো অপেক্ষা আমিও করছি। অঙ্ক
একটাও পারিনা। শুধু শুধু এঁকে খাতা ভরাচ্ছি। সিঙ্গাড়ার অছিলায় যদি পার পাওয়া যায়!
তাহলে খারাপ কী?
না ও ভেগে গেল! আমাদের চিপায় ফেলে সে পগার পার। দাদাভাই
আমার দিকে চেয়ে বললেন।
আমি কিছু না বলে দরজার দিকে উম্মুখ হয়ে চেয়ে থাকি।
কিছুক্ষন পর শিমুল মুচকি হেসে ক্লাসে ঢুকে।
অহ বড্ড বাঁচা গেল। আজ তো এই বুড়ো বামটা পিঠিয়ে হাড় গোড়
ভেঙ্গে ফেলত। দাদা ভাই দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে বলেন।
তিনি খাতায় বড় মনোযোগ দিয়ে কী লিখতে থাকেন। আমি মাথা
উঁচু করে দেখার চেষ্টা করি। দেখি, চিঠির মতো করে কী লিখছেন।
প্রিয় বুড়ো
স্যার,
সিঙ্গাড়াগুলো খেয়ে চুপচাপ কেটে পড়। আজ কার মুখ দেখে যে
ঘুম থেকে উঠেছি। এই সকাল বেলা-ই আমার
বিশটা টাকা জলে গেল। জলে যাক আর চুলোয় যাক। কোন সমস্যা নয়। তুমি বাবা চলে গেলে
আমার ত্যাগটুকু স্বার্থক হবে। এই পুত্রের বয়সি ছেলে-মেয়েদের সামনে আর মার খেতে
চাইনা। সরকার বেত্রাঘাতের বিরুদ্ধে আইন করেছে, তুমি তো তা মানবা না। তোমাকে মামলা
দিয়ে জেলের ভাত না খাওয়ালে শান্ত হবেনা। সহজ মামলা না, কঠিন মামলা।
শিমুল স্যারের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চাচ্ছে,
কিন্তু পারছেনা। স্যার অন্যদিনের ন্যায় সিঙ্গাড়া দেখে হামলে পড়েননি। তাঁর চেয়ারে
বসে একদৃষ্টিতে টেবিলের দিকে চেয়ে আছেন। মুখ কিছুটা নরমাল মনে হচ্ছে। আগের মতো
ভয়ংকর ভাব নেই। হয়তো সিঙ্গাড়া ভয়ংকর ভাবটা কেটে দিয়েছে। স্যার মাথা ঝাকিয়ে শিমুলকে
চলে যেতে বললেন।
এই খাতা জমা দাও। তাড়াতাড়ি জমা দাও। এই হাসান, সবার খাতা
তুলে আন। স্যার হুংকার দিলেন।
আমি কাঁপা হাতে খাতা জমা দিই। হাসানকে কাতর কন্ঠে বললাম,
দোস্ত, সবার নিচে রাখ রে।
তোর খাতা সবার উপরে রাখছি। এই দেখ!
প্লিজ দোস্ত.......
হারামিটা সবার উপরেই রেখে দিয়েছে। ওকে না বলাই ভাল ছিল।
দশটা অঙ্কের পরীক্ষা ছিল। আটটা অবশ্যই দিতে হবে।
আমার বড়জোর তিনটি অঙ্ক সঠিক হবে। তাও ঠেলিয়ে ধাক্কিয়ে।
আমি মনে মনে ইয়া মুকাদ্দিমু পড়ছি। বিপদের সময় আল্লাহ
পাকের এই নামটা জপলে কাজ দেয়। আরেকটি দুয়া আছে। দুয়া ইউনুছ। ইউনুছ নবী এই দুয়া পড়ে
বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তবে দুয়াটা এখন মনে পড়ছেনা। বিপদের সময় অনেক কিছুই মনে
পড়েনা।
স্যার সব খাতা গুনলেন। হাসান, দেখতো ছাত্র-ছাত্রী কত জন।
আষট্টি জন স্যার।
তুই না গুনে কী করে বললি?
আগেই গুনে রেখেছি স্যার।
সব কিছুতেই তার বাড়াবাড়ি। এক নম্বর হয় বলেই কী যে
অহংকার। বুক ফুলে সামন দশ বিঘৎ বেড়ে যায়। আমরাও এক নম্বর হতে পারি। শুধু পড়াটা
মাথায় ঢুকেনা। এই আর কি!
কোন দুজনে খাতা জমা দাওনি? দাঁড়িয়ে যাও। স্যার কথাটা
বলেই ক্লাসে হাঁটা ধরেন।
দাঁড়াচ্ছ না কেন? খুঁজে পেতে কি আমার সময় লাগবে? পরে
পিঠিয়ে ছাল তুলে ফেলব।
শিমুল মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ায়। দাদাভাইও উঠে দাঁড়ান।
তবে তার মুখটা হাসি হাসি।
স্যার সোজা দাদাভাইর নিকট আসলেন। কী, খাতা জমা দাওনি
কেন? তুমি আবার মিটিমিটি হাসছ? লজ্জা লাগে না! তোমার ছেলের বয়সীরা অঙ্ক করে খাতা
জমা দিচ্ছে। আর তুমি বেহায়ার মতো হাসছ। তোমাকে আজ মারব না। তোমাকে মেরে মেরে আমার
হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। কানে ধরে সারা ক্লাস হাঁটতে থাক।
সিংগাড়া স্যার.......
আবার কথা বলে? তাড়াতাড়ি কর। স্যার ধমক দিলেন।
দাদাভাই ভয়ার্তকন্ঠে বলার চেষ্টা করলেন, স্যার
সিং........
বাড়িয়ে এক্কেবারে...... স্যার বলা শেষ করার আগেই দাদাভাই
পাগলের মতো কানে ধরে হাঁটতে থাকেন। হাঁটছেন না বলে দৌড়াচ্ছেন বলাটাই ঠিক হবে।
মুখটা লাল হয়ে আছে। বেচারা অনেক লজ্জা পেয়েছে।
স্যার বললেন, যাও সবার খাতা নিয়ে নাও আজ খাতা দেখবনা।
স্যার শিমুলের দিকে এখনও তাকাননি। মনে হয় আর তাকাবেনও
না। দাদাভাইর উপর গজরাতে গজরাতে তার টেবিলের কাছে যান। কায়দা করে সিঙ্গাড়ার
প্যাকেট নিয়ে চলে যান। অন্যদিনের মতো ক্লাসে বসেই সাবাড় করেননি।
আমরা হই হুল্লোড় করতে থাকি। অনেক বড় ফাঁড়া কেঁটে গেছে।
দাদাভাই গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। স্যার চলে যেতেই তার রানিং
শেষ হয়ে যায়। শিমুল শুকনো মুখে তার সামনে আসে।
তুই আমার বিশটাকা দিস। দাদাভাই ক্রুব্দ কন্ঠে বললেন।
আমি কী করলাম? তুমি বললে স্যারকে নাস্তা করাতে। আমি
করালাম। আমার দোষ কোথায়?
তুই স্যারকে আমার কথা বলবি না?
সেইটা তুমি বলেছিলে? আমি তো মনে করলাম। আমি নাস্তা করাব।
তুমি পাম-পুশিং দিয়ে সব ঠিক ঠাক করে ফেলবে।
দাদাভাই আর কিছুনা বলে গোমড়া মুখে বসে থাকেন।
হাসান হাসতে হাসতে বলে, আচ্ছা দাদাভাই, তুমি হটাৎ ‘স্যার সিঙ্গাড়া’ বললে কেন?
আমি অন্যদিকে চেয়ে বললাম, তিনি হয়তো বলতে চেয়ে ছিলেন,
স্যার সিঙ্গাড়া খাওইয়ালাম। তারপরও শাস্তি দিচ্ছেন কেন?
Comments
Post a Comment