আমি বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের ৩য় তলায় সাধারণ পাঠকক্ষে প্রবেশ করি। সময় একটা
ত্রিশ-পয়ত্রিশ। এগারটার দিকে এসেছিলাম। এতক্ষণ দু’তলার পত্রিকা
কক্ষে ছিলাম। পত্রিকা কক্ষের এক পাশে রবি ইন্টারনেট কর্ণার আছে। সেখানে বিশ মিনিট
ফ্রি ইন্টারনেট ইউজ করা যায়। আমি যে দিনই আসি,
ইন্টারনেট ইউজ করি।
আমার ল্যাপটপ আছে। ইন্টারনেট মডেমও আছে। এখানে ফ্রি ইউজের কারন হলো, আমার
একটি ব্লগ আছে। কিছুদিন আগে তৈরি করি। সেটি অন্য কম্পউটার থেকে দেখা। অন্য জায়গা
থেকে নিজের সৃষ্টি কর্ম দেখার আলাদা মজা আছে।
আজ ভালো করে ইন্টারনেট ইউজ করতে পারিনি। পিসি-৩ মানে কোণার দিকের
কম্পউটারের জন্যে এন্ট্রি করি। একটু আড়ালে থাকতে। কিন্তু সেটি খুবই কম স্পিডে
সার্ভিস দেয়। মনে হয়, একবার সার্চ করতেই নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাবে। আগেও একবার
এর সম্মুখিন হই। আজ ভুলে আবারও সেটিতে যাই।
আমি ধীর পায়ে উপন্যাসের র্যাকের কাছে আসি। বিভাগীয় গন্থাগারে বড় সুবিধা
হলো, প্রতিটা বই বিষয়বস্তু অনুযায়ী সাজানো। উপন্যাসের র্যাকে প্রবন্ধের বই পাওয়া
যাবেনা। নাটকের জায়গায় ইতিহাসের বই দেখা যাবেনা। প্রচুর বইও আছে। আমার ধারণা,
বাংলাদেশে এমন কোন বিষয়ের বই নেই, যা গণগ্রন্থাগারে পাওয়া যাবেনা। হয়তো কোন বিষয়ে
কম হবে।
মুসলিম সাহিত্য সংসদেও অনেক বই আছে। তবে সেখানে বইগুলো খুবই এলোমেলো ভাবে
রাখা। একটি বই খোঁজতে সারা পাঠাগার তল্লাশি চালানো লাগে।
হঠাৎ মনে হলো, আমার তো জুহরের নামায পড়া হয়নি। মনটা আনচান করে ওঠে। শরীরে
ভারিক্কি ভাব চলে আসে। নামায না পড়ার লক্ষণ। প্রতিদিন শক্ত নিয়ত করি, আগামীকাল ফজর
থেকে প্রতি ওয়াক্তের নামায পড়ব। ফজরের নামাযটা ঠিক মতো পড়িও। বাধ সাধে জুহর, আছর
কিংবা ঈশার সময়। প্রচণ্ড রকমের অলসতা শরীরে জেঁকে বসে। আজ কেমন করে যেন সেটাকে
পাত্তা দিলাম না।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখি, কাউ কাউ মার্কা লাইব্রেরিয়ানটা। শার্টের হাতা
ঘুটাচ্ছে। মনে হয় অযু-টযু করতে এসেছে। তাকে দেখা মাত্র আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
সে পত্রিকা কক্ষের দায়িত্বে থাকা কালে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। শুধু আমার না,
আমার মতো আরো অনেকেরই। ব্যাটা খালি কাউ কাউ, ঘাউ ঘাউ করে।
এই এই তুমি এটা ভাঁজ করে পড়ছ কেন? এইটা কী করছ? অ্যাঁ মোবাইলে কথা বলা
নিষেধ জান না! তোমার হাতে কী পত্রিকা আমারদেশ নাকি। একটু দাও তো দেখি। একদিন আমি
আমারদেশে গুরুত্ত্বপূর্ণ একটা নিউজ পরছি। হঠাৎ শুনি কাউ কাউ। আমার অত্মরাত্মা
কেঁপে ওঠে। তাড়াতাড়ি পত্রিকাটা তার হাতে তুলে দেই। বাবা নিয়ে যা! দরকার নেই মহা
গুরুত্ত্বপূর্ণ খবর জানার।
এখন সে শিশুকিশোর পাঠ কক্ষে থাকে। একদিন জাফর ইকবালের একটা বই খোঁজতে
সেখানে যাই। বই খুঁজব কী! তিনটা বাচ্চাকে সে যেভাবে আদব-আক্কেল শিখাচ্ছে, তা দেখেই
আমি পুটুশ। বাচ্চাগুলো কাঁদো কাঁদো মুখে তার দিকে চেয়ে আছে। তারা হয়তো ভাবছে, এত
দেখি গণিত স্যার থেকেও মারাত্মক।
আমি ওযু শেষ করে উঠতে যাব, অমনি চোখ যায় বাথরুমের দিকে। আমার হার্টে কিসের
ধাক্কা লাগে। লাইব্রেরিয়ানটি চোখ বড় বড় করে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দ্রুত
আমার পায়ের দিকে তাকাই। না সে আমার পা দেখছেনা। একটু দূরে রাখা রাখা তার
জুতা-মুজার দিকে তাকাচ্ছে। আমার কারনে হয়তো জুতা রেখে কাজ সারতে পারছেনা। ব্যাটা
কত্ত বড় গর্দভ! জুতা খুলে বাথরুমে যাচ্ছে। কত লোকের জুতার ময়লা লেগে আছে।
আমি বিনীত ভাবে বললাম, স্যার আসেন, একসঙ্গে নামায পড়ব।
হ্যা যাও, আমি আসছি। সে তার কাউ কাউ মার্কা গলায় বলল।
আমার আচরণে আমি নিজেই বিস্মিত। এ আমি কী করলাম? এই ব্যাটাকে নিয়ে নামায
পড়ব! যদি নামাযেও তার আসলটা শুরু করে।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি। এত সময় মারছে কেন? কতক্ষণ হলো সুন্নত চার রাকআত
পড়লাম। মনে হয় সে নামাযের উছিলায় একটু রেস্ট-টেস্ট নিচ্ছে। সেটা মন্দ নয়।
একটু পর সে হাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নামায ঘরে ঢুকে। আমি বললাম, নামায পড়ে
নিই স্যার!
অ্যাঁ আমি তো সুন্নত পড়িনি।
ঠিক আছে স্যার, আপনি সুন্নত পড়ুন আমি অপেক্ষা করছি।
অ্যাঁ অ্যাঁ, তোমার কি এত সময় হবে? বলছিলাম কি, তুমি ছাত্র মানুষ। তোমার অত
সময় হবে? তার কাউ কাউ শুরু হয়েছে।
ঠিক আছে স্যার। আমি একাই ফরয নামায পড়ে নিচ্ছি। আমার গলার স্বরটা মনে হয়
অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়।
সে তার গাউ গাউ গলায় বলল, আমি কি তোমায় বুঝাইতে পেরেছি?
সে আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল। আমি মাথা দ্রুত উপর নিচ করে ‘বুঝেছি’ বলেই নামায শুরু করে
দিই। যত দ্রুত পারা যায় এ ব্যাটার কাছ থেকে ভাগি। নইলে মাথায় অবশিষ্ট যে ঘিলু এখনো
রয়েছে, তা যে কখন গোবরে পরিণত হবে; ঠেরই পাবনা।
নামাযে মন দিতে পারছিনা। শুধু নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। এই ব্যাটা কাউ কাউ গাউ
গাউকে কেন যে নামায পড়ার কথা বলতে গেলাম। চুপচাপ একা একা নামায পড়ে চলে যেতাম। কোন
আউলা-ঝাউলা নাগাল পেতনা। হয়তো দামি বনতে গিয়ে এ কাজটি করেছি।
নামায পড়তে আরো দু’তিন জন আসে। সম্ভবত দরগা
মাদ্রাসার ছাত্র। তারা আওয়াজ দিয়ে গল্প করছে। আমার ভয়ংকর রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে হয়,
নামায ছেড়ে আচ্ছাসে কয়েকটা ঝাড়ি দেই। এটা কি আড্ডাখানা? চিল্লাপাল্লা করবে? একেতো
মসজিদ তার ওপর দুজন লোক নামায পড়ছে। হোক না একজন কাউ কাউ!
এ কাজটি হয়তো আমাকে করতে হবেনা। লাইব্রেরিয়ানটিই করে ফেলবে।
আমি সালাম ফেরাতেই তারা লাফ মেরে ওঠে। ইমামতি করার জন্যে আমাকে বিনীত
ভঙ্গীতে ইশারা করে। এর মধ্যে লাইব্রেরিয়ানও সুন্নত শেষ করে দাঁড়ায়।
আমি পিছনের কাতারে এসে বললাম, আমার ফরয নামায পড়া শেষ। আপনারা পড়ুন।
আমি সুন্নত পড়া শুরু করি। তারা আর কিছু না বলে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে
ইমাম বানায়। লাইব্রেরিয়ানটি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কী জন্যে তাকাচ্ছে;
বুঝতে পারছিনা।
সুরা ফাতিহা পড়ে তেরছা চোখে চেয়ে দেখি, সে এখনো আমার দিকে চোখ বড় বড় করে
তাকিয়ে আছে। তার এই তাকানোয় বুঝা যায়, সে খুব বিস্মিত হয়েছে। এমন বিস্ময় এ জীবনে
আর কখনো হয়নি।
যদি একজনের মনের কথা অন্যজন শুনতে পেত। তা হলে লাইব্রেরিয়ান শুনত- এই ব্যাটা
কাউ কাউ গাউ গাউ! তাপ্পড় মেরে বত্রিশটা দাত ফেলে দেব। তাকা সামনের দিকে! এখানে
নামাযে এসেছিস, না আমাকে দখতে এসেছিস। শালা উল্লুক!
Comments
Post a Comment